জমির খতিয়ান অনুসন্ধান করার নতুন নিয়ম

 ২০২৫ সালে জমির খতিয়ান অনুসন্ধান প্রক্রিয়ায় বেশ কিছু যুগান্তকারী সংস্কার আনা হয়েছে, যা নাগরিকদের জন্য এই সেবাকে আরও সহজলভ্য, স্বচ্ছ ও দ্রুতগামী করেছে। সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ রূপকল্প বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে ভূমি ব্যবস্থাপনাকে সম্পূর্ণ অনলাইনভিত্তিক করতে এই পরিবর্তনগুলো আনা হয়েছে। নিচে নতুন এই নিয়মাবলী সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো:

প্রথমত, ২০২৫ সালের নতুন নিয়মে খতিয়ান অনুসন্ধানের জন্য একটি কেন্দ্রীয়কৃত ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম চালু করা হয়েছে। এই প্ল্যাটফর্মে দেশের সকল জমির রেকর্ড ডিজিটালাইজড করা হয়েছে। এখন যে কেউ ভূমি মন্ত্রণালয়ের অফিসিয়াল ওয়েবসাইট (https://www.minland.gov.bd) অথবা 'ভূমি সেবা' মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে নিজের জমির খতিয়ান সহজেই দেখতে পারবেন। এই সিস্টেমে প্রবেশ করতে ব্যবহারকারীকে তার জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর, মোবাইল নম্বর এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় তথ্য প্রদান করতে হবে। সিস্টেমটি বায়োমেট্রিক ভেরিফিকেশনের মাধ্যমে ব্যবহারকারীর পরিচয় নিশ্চিত করে, যা জালিয়াতি রোধে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে।

দ্বিতীয়ত, নতুন নিয়মে খতিয়ান অনুসন্ধানের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের তালিকা সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে। এখন শুধুমাত্র জাতীয় পরিচয়পত্রের কপি এবং জমির পূর্ববর্তী রেকর্ডের রেফারেন্স নম্বর (যদি থাকে) প্রদান করলেই চলে। তবে জমির সীমানা নির্ধারণের জন্য স্যাটেলাইট ইমেজ ভিত্তিক মানচিত্র ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, যা জমি সংক্রান্ত বিরোধ কমাতে সাহায্য করবে। এই মানচিত্রগুলো সরকারি ভাবে প্রস্তুত করা হয়েছে এবং ভূমি সেবা পোর্টাল থেকে বিনামূল্যে ডাউনলোড করা যায়।

তৃতীয়ত, ফি কাঠামোতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনা হয়েছে। এখন খতিয়ান অনুসন্ধানের জন্য নির্ধারিত ফি অনলাইনে পরিশোধ করা যায়, যা আগের চেয়ে ৩০% কম। পেমেন্টের জন্য বিকাশ, নগদ, রকেটসহ সকল মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস এবং অনলাইন ব্যাংকিং সিস্টেম সমর্থিত। পেমেন্টের পর ব্যবহারকারীকে একটি ইউনিক ট্র্যাকিং নম্বর দেওয়া হয়, যার মাধ্যমে সে তার আবেদনের অবস্থা অনলাইনে ট্র্যাক করতে পারে।

চতুর্থত, সেবা প্রদানের সময়সীমা সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে। নতুন নিয়ম অনুযায়ী, সাধারণ খতিয়ান অনুসন্ধানের জন্য সর্বোচ্চ ৭ কর্মদিবস এবং জরুরি ক্ষেত্রে ৪৮ ঘন্টার মধ্যে সেবা প্রদানের বিধান রাখা হয়েছে। সেবা প্রাপ্তির পর ব্যবহারকারীকে এসএমএস এবং ইমেইলের মাধ্যমে নোটিফিকেশন পাঠানো হয়। যদি কোনো কারণে আবেদনটি বাতিল হয়, তাহলে তার কারণসহ বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেওয়া হয় এবং পুনরায় আবেদনের সুযোগ দেওয়া হয়।

পঞ্চমত, নতুন এই ব্যবস্থায় জমি সংক্রান্ত সকল তথ্য ব্লকচেইন প্রযুক্তিতে সংরক্ষণ করা হচ্ছে, যা তথ্যের নিরাপত্তা ও অবিকলতা নিশ্চিত করে। এই প্রযুক্তির কারণে কেউ জমির রেকর্ডে অননুমোদিত পরিবর্তন করতে পারবে না। এছাড়াও, প্রতিটি লেনদেনের ডিজিটাল রেকর্ড রাখা হয়, যা ভবিষ্যতে কোনো বিরোধের ক্ষেত্রে প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করা যাবে।

ষষ্ঠত, নতুন নিয়মে বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়েছে প্রবাসী বাংলাদেশীদের জন্য। তারা এখন বিদেশ থেকে সরাসরি অনলাইনে আবেদন করতে পারবেন এবং ই-মেইলের মাধ্যমে খতিয়ানের কপি সংগ্রহ করতে পারবেন। এজন্য তাদেরকে কনস্যুলার বা দূতাবাস থেকে ভেরিফিকেশন সার্টিফিকেট সংগ্রহ করতে হবে, যা অনলাইনেই করা যায়।

সপ্তমত, ভূমি সেবা কেন্দ্রগুলোকে আরও আধুনিক করা হয়েছে। এখন প্রতিটি উপজেলা এবং ইউনিয়ন পর্যায়ে ডিজিটাল সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে, যেখানে প্রশিক্ষিত কর্মকর্তারা নাগরিকদেরকে এই সেবা গ্রহণে সহায়তা প্রদান করেন। এসব কেন্দ্রে বায়োমেট্রিক ডিভাইস, হাই-স্পিড ইন্টারনেট এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সরবরাহ করা হয়েছে।

অষ্টমত, নতুন এই ব্যবস্থায় একটি অভিনব বৈশিষ্ট্য যোগ করা হয়েছে, যেখানে ব্যবহারকারী তার জমির খতিয়ানের সাথে সংশ্লিষ্ট সকল আইনগত দলিল একসাথে দেখতে পারবেন। যেমন: দাখিলা, নামজারি, বায়া দলিল ইত্যাদি। এই সেবাটি অতিরিক্ত ফি প্রদান সাপেক্ষে পাওয়া যায়।

নবমত, জমি সংক্রান্ত বিরোধ নিরসনের জন্য একটি বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছে, যা অনলাইনেই শুনানি পরিচালনা করে। এই ট্রাইব্যুনালের রায় ৯০ দিনের মধ্যে দেওয়ার বিধান রাখা হয়েছে, যা আগের চেয়ে অনেক দ্রুততর।

দশমত, নতুন এই নিয়মে তথ্য প্রাপ্তির অধিকারকে আরও শক্তিশালী করা হয়েছে। এখন যে কেউ অনলাইন আবেদনের মাধ্যমে যে কোনো জমির সাধারণ তথ্য (যেমন: মালিকের নাম, জমির পরিমাণ) বিনামূল্যে জানতে পারবেন। তবে বিস্তারিত তথ্যের জন্য স্বল্প ফি প্রদান করতে হবে।

২০২৫ সালের এই নতুন নিয়মগুলো বাস্তবায়নের ফলে জমি সংক্রান্ত সেবা গ্রহণ প্রক্রিয়া আগের চেয়ে অনেক সহজ, স্বচ্ছ ও দ্রুত হয়েছে। এটি নাগরিকদের সময় ও অর্থ দুটোই সাশ্রয় করবে এবং জমি সংক্রান্ত জটিলতা ও মামলা কমাতে সাহায্য করবে। তবে এই সিস্টেমের সফল বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন সকল নাগরিকের সচেতনতা এবং সরকারি কর্মকর্তাদের দক্ষতা। সরকার ইতিমধ্যে এই সিস্টেম সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন প্রচারণা চালাচ্ছে এবং ভূমি অফিসের কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ প্রদান করছে।

إرسال تعليق (0)
أحدث أقدم