bangladeshi newspaper online

 ✴️বাংলাদেশে ভাইরাসজনিত সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার কারণ:

বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ, যেখানে জনসংখ্যার ঘনত্ব, অপর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা, জলবায়ু পরিবর্তন, নগরায়ন, স্বাস্থ্য-শিক্ষার ঘাটতি এবং জীববৈচিত্র্যের চাপ মিলিয়ে ভাইরাসজনিত সংক্রমণের জন্য একটি অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, করোনা ভাইরাস (COVID-19), হেপাটাইটিস, এভিয়ান ফ্লু, নিপাহ ভাইরাস, হাত-পা-মুখে রোগসহ বিভিন্ন ভাইরাস সংক্রমণের ঘটনা বেড়েই চলেছে। এই পরিস্থিতির পেছনে একাধিক সামাজিক, পরিবেশগত এবং অর্থনৈতিক কারণ দায়ী।

প্রথমত, অতিরিক্ত জনসংখ্যা ও জনঘনত্ব ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার অন্যতম প্রধান কারণ। বাংলাদেশে প্রতি বর্গকিলোমিটারে প্রায় ১২০০ জন মানুষ বসবাস করে, যা বিশ্বের সর্বোচ্চ জনঘনত্বের দেশগুলোর মধ্যে একটি। ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুরের মতো শহরগুলোতে ঘনবসতির কারণে এক ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তিতে ভাইরাস সহজেই ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষ করে গণপরিবহন, বাজার, স্কুল-কলেজ এবং অফিসগুলোতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা প্রায় অসম্ভব, ফলে একটি সংক্রমণ মুহূর্তের মধ্যে কয়েকশ বা হাজারো মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে পারে।

দ্বিতীয়ত, নগরায়নের অনিয়ন্ত্রিত প্রসার ও অপর্যাপ্ত নগর-পরিকল্পনা একটি বড় সমস্যা। অনেক শহরে জলাবদ্ধতা, অপরিচ্ছন্নতা, ড্রেনেজ ব্যবস্থার অভাব এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় অব্যবস্থাপনা দেখা যায়, যা মশাবাহিত ভাইরাস যেমন ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া বিস্তারে সহায়তা করে। জমে থাকা পানিতে এডিস মশার প্রজনন বাড়ে এবং মশার সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভাইরাস সংক্রমণের হারও বাড়ে। বর্ষাকালে বা গ্রীষ্মকালে এই সমস্যা আরও প্রকট হয়।

তৃতীয়ত, স্বাস্থ্যসেবা খাতে দুর্বলতা ও সীমিত সক্ষমতা ভাইরাসজনিত রোগের বিস্তার ঠেকাতে একটি বড় বাধা। দেশের অনেক সরকারি হাসপাতালেই পর্যাপ্ত চিকিৎসক, নার্স, রোগ নির্ণয় যন্ত্রপাতি এবং ওষুধের অভাব রয়েছে। গ্রামীণ ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্বাস্থ্যসেবা অত্যন্ত সীমিত। ফলে রোগী প্রাথমিক লক্ষণগুলো অবহেলা করেন, চিকিৎসা নিতে দেরি করেন এবং এর মধ্যেই অন্যদের মধ্যে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে। তাছাড়া, ভাইরাস সনাক্তে পর্যাপ্ত পরীক্ষাগারের অভাব এবং সময়মতো রোগ নির্ণয় না হওয়ায়ও সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে বড় ধরনের সমস্যা তৈরি হয়।

চতুর্থত, মানুষের স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতনতার অভাব এবং কুসংস্কার অনেক সময় ভাইরাস সংক্রমণ বাড়িয়ে দেয়। অনেকে ভাইরাসজনিত অসুস্থতাকে সাধারণ জ্বর মনে করে অবহেলা করেন, ফলে চিকিৎসা গ্রহণ না করেই সমাজে মেলামেশা চালিয়ে যান এবং অন্যদের আক্রান্ত করে ফেলেন। এছাড়া, কিছু মানুষ এখনও আধুনিক চিকিৎসার পরিবর্তে ঝাড়ফুঁক বা তাবিজ-কবচে বিশ্বাস করেন, যা রোগের প্রকৃত চিকিৎসা বিলম্বিত করে। জনসচেতনতা বাড়াতে প্রচার-প্রচারণার ঘাটতি, শিক্ষার অভাব এবং মিডিয়ার ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ।

পঞ্চমত,🗯️জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ বিপর্যয় ভাইরাসের প্রজনন ও বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে মশাবাহিত ভাইরাস যেমন ডেঙ্গু এবং ম্যালেরিয়া বিস্তারের মৌসুম দীর্ঘায়িত হচ্ছে। পাশাপাশি, বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের পর আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে হাজার হাজার মানুষ গাদাগাদি করে থাকেন, যেখানে স্বাস্থ্যবিধি মানা সম্ভব হয় না, ফলে সংক্রমণের ঝুঁকি বহুগুণে বেড়ে যায়। পরিবেশ দূষণের কারণে ভাইরাসবাহী প্রাণীর সংখ্যা ও গতিবিধি পরিবর্তিত হচ্ছে, যা মানুষ ও প্রাণীর মধ্যে সংক্রমণের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয় (যেমন নিপাহ ভাইরাস বা এভিয়ান ফ্লু)।

ষষ্ঠত, প্রাণীজ উৎস থেকে ভাইরাস সংক্রমণ (Zoonotic viruses) বাংলাদেশে একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কৃষিনির্ভর সমাজে মানুষ ও প্রাণীর ঘনিষ্ঠ সহাবস্থানের কারণে প্রাণী থেকে মানুষের মধ্যে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা বেশি। উদাহরণস্বরূপ, নিপাহ ভাইরাস বাদুড়ের মাধ্যমে খেজুরের রস খাওয়ার মাধ্যমে মানুষের মধ্যে ছড়ায়। একইভাবে, মুরগির খামারে এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জার ঝুঁকি এবং গবাদি পশুর হাটে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ মারাত্মক ভাইরাস সংক্রমণের সম্ভাবনা তৈরি করে।

সপ্তমত, বিদেশ গমন ও প্রবাসফেরত ব্যক্তিদের অনিয়ন্ত্রিত চলাচলও ভাইরাস ছড়িয়ে দেওয়ার একটি মাধ্যম। বিশ্বায়নের যুগে প্রতিদিন বাংলাদেশ থেকে হাজার হাজার মানুষ বিদেশে যান বা ফেরেন। কোনো সংক্রামক ভাইরাস যদি কোনো দেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং তা যদি ভ্রমণকারীদের মাধ্যমে বাংলাদেশে আসে, তাহলে সেটা দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে। COVID-19 মহামারিতে এর সুস্পষ্ট উদাহরণ দেখা গেছে, যেখানে বিদেশফেরতদের মাধ্যমে সংক্রমণ দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে।

অষ্টমত, টিকাদান কর্মসূচির দুর্বলতা ও অস্বচ্ছতা অনেক সময় ভাইরাস প্রতিরোধকে ব্যাহত করে। বাংলাদেশ সরকার বেশ কয়েকটি ভাইরাসের বিরুদ্ধে নিয়মিত টিকা প্রদান করে (যেমন পোলিও, হেপাটাইটিস-বি, হাম), কিন্তু অনেক অঞ্চলে এখনও শতভাগ টিকা প্রদান নিশ্চিত করা যায়নি। এছাড়া কিছু ক্ষেত্রে ভ্যাকসিন নিয়ে গুজব, ভয় বা অবিশ্বাস দেখা দেয়, যা টিকাদান কার্যক্রমকে ব্যাহত করে। জনগণের সচেতনতা, ভ্যাকসিনের সহজলভ্যতা এবং কার্যকর বাস্তবায়ন না হলে ভবিষ্যতে আরও ভাইরাস সংক্রমণ ঘটতে পারে।

নবমত, সীমান্তবর্তী এলাকায় নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ঘাটতি ভাইরাসের ছড়িয়ে পড়ার আরেকটি পথ। প্রতিবেশী দেশ থেকে যদি কোনো ভাইরাস প্রবেশ করে, তবে সেগুলোর দ্রুত বিস্তার ঠেকানো কঠিন হয়, বিশেষ করে যদি সীমান্ত দিয়ে নিয়মিত অবৈধ অনুপ্রবেশ ঘটে। এর সাথে যুক্ত আছে পর্যাপ্ত স্ক্রিনিং ব্যবস্থা ও কোয়ারেন্টাইন সেন্টারের অভাব।

সবশেষে, গবেষণা ও তথ্য-উপাত্তের ঘাটতি ভাইরাস প্রতিরোধে বড় বাধা হিসেবে দেখা যায়। বাংলাদেশে ভাইরাস নিয়ে গবেষণা কার্যক্রম এখনও সীমিত পর্যায়ে রয়েছে। ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব, সংক্রমণ হার, মৃত্যুহার ইত্যাদি বিষয়ক সঠিক ও হালনাগাদ তথ্য না থাকলে পরিকল্পনা ও প্রতিরোধ কার্যক্রমে ঘাটতি থাকে।

সব মিলিয়ে বলা যায়, বাংলাদেশে ভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি বহুমাত্রিক এবং তা নিরসনে প্রয়োজন একাধিক খাতে সমন্বিত কার্যক্রম। সবার আগে প্রয়োজন জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি, স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নয়ন, নগর ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়ন এবং জলবায়ু অভিযোজন কৌশল গ্রহণ। একইসাথে সরকারের পরিকল্পনা, বেসরকারি উদ্যোগ, আন্তর্জাতিক সহায়তা ও গণমাধ্যমের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ভাইরাস সংক্রমণ রোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। ভবিষ্যৎ মহামারী ঠেকাতে হলে এখন থেকেই কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ অপরিহার্য।

চাইলে আপনি এটি এসাইনমেন্ট, প্রতিবেদন বা নিবন্ধ হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন। প্রয়োজনে আরও তথ্য, উপশিরোনাম বা গ্রাফ যুক্ত করতেও সাহায্য করতে পারি।

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post